শহীদনূর আহমেদ ::
সেলাই মেশিনের একঘেয়ে আওয়াজের আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক কিশোরীর কান্না, ছিল না বিদ্যুতের আলো, ছিল না ভালো পোশাক কিংবা প্রয়োজনীয় বইপত্র। তবে ছিল অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর বাবার দেখানো স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে শাল্লা উপজেলার হবিবপুর ইউনিয়নের শিবপুর গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান অর্পা তালুকদার।
পিতা হারানোর পর মাত্র ৮ বছর বয়সেই জীবনের নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হয় অর্পা। তখন সে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। শোককে শক্তিতে পরিণত করে ছোটবেলায়ই মায়ের কাছ থেকে শিখে নেয় সেলাইয়ের কাজ। পড়াশোনার পাশাপাশি চলে জামা-কাপড় সেলাই। স্কুলে যাওয়ার আগে কিংবা স্কুল থেকে ফেরার পরে পড়াশোনার পাশাপাশি চালিয়ে যেতেন পাড়া-প্রতিবেশী ও বান্ধবীদের জামা সেলাইয়ের কাজ। এভাবে চলে পরিশ্রম আর পড়ালেখার কঠিন সমন্বয়।
বর্তমানে ছোট ভাই অর্ঘ্য তালুকদার আর মা অলি রানী তালুকদারকে নিয়ে শাল্লা সদরে এক রুমের একটি টিনের বাসা ভাড়া করে থাকেন অর্পা। ছোট রুমের এক কোণে সেলাই মেশিন, আরেক কোণে একটি ছোট পড়ার টেবিল। সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে সেলাই করে যেতো, এরপর মা সেলাই করতেন। বিকালে স্কুল থেকে ফেরার পরে মায়ের সাথে গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি পরিবারের জীবিকার জন্য আবার দর্জির কাজ করতেন অর্পা। অর্থের অভাবে মা-মেয়ে একটি সেলাই মেশিন দিয়েই কাজ করতেন। এভাবেই চলছে মা-মেয়ের হার না মানা সংগ্রামী জীবন। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও অর্পা চালিয়ে গেছেন তার পড়ালেখা।
অর্পা পড়েছে শাল্লার গোবিন্দ চন্দ্র সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। সদ্য প্রকাশিত ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ১,৩০০ নম্বরের মধ্যে ১,১৯৭ নম্বর পেয়ে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে। দারিদ্র্যতার মধ্যে এমন কৃতিত্বে খুশিতে কেঁদে ফেলেন মা অলি রাণী তালুকদার। তবে সাফল্যের মধ্যেও অর্পার চোখে এখন অনিশ্চয়তার ছায়া। উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি এবং লেখাপড়ার খরচ কিভাবে বহন করবে - তা নিয়েই দুশ্চিন্তা। বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়েকে ডাক্তার বানানোর। সেই স্বপ্ন পূরণের পথে এখন সবচেয়ে বড় বাধা অর্থসংকট। অদম্য মেধাবী অর্পা তালুকদার বলেন, ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। সেই থেকে জীবন যুদ্ধ শুরু। বাবার স্বপ্ন ছিল আমি যেন বড় হয়ে ডাক্তার হই। বাবার স্বপ্ন পূরণে শত কষ্টের মধ্যে পড়ালেখা চালিয়েগেছি। পড়াশোনার পাশাপাশি দর্জির কাজ করেছি। কাজ শেষে রাত জেগে পড়াশোনা করেছি। আমার এই সাফল্যে মায়ের অবদান বেশি। আমার শিক্ষকদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তারা আমাকে বিনাবেতনে পড়িয়েছেন।
অর্পা বলেন, এসএসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে আমি খুশি। কিন্তু এতোদিন তো কোনোভাবে পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারছিলাম কিন্তু এখন উচ্চশিক্ষার খরচ কেমনে জোগাড় করবো, কোথায় ভর্তি হবো? পড়াশোনার খরচের সংস্থান করার সামর্থ্য আমাদের নেই। আমি জানিনা আমার স্বপ্নের যাত্রা থেমে যাবে কি-না। অর্পা’র মা অলি রাণী তালুকদার বলেন, আমার মেয়ে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে। সে দিন-রাত আমার সাথে কাজ করেছে। এতো অভাবের মধ্যে তার এমন ফলাফলে আমি অনেক খুশি। এখন তার ভর্তি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।
দারিদ্র্যতার সাথে হার না মানা অর্পা তালুকদার এখন অনুপ্রেরণার নাম। অদম্য মেধাবীকে নিয়ে গর্বিত তার প্রতিবেশীরা। সরকারি ও বেসরকারি সহায়তায় পেলে অর্পা তালুকদার সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছতে পারবেন বলে জানান তার শিক্ষক ও সহপাঠীরা।
গোবিন্দ চন্দ্র সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক সজল চন্দ্র সরকার বলেন, অর্পার সাফল্যে আমরা অনেক খুশি। সে একজন সংগ্রামী কিশোরী। দারিদ্র্যতা যে মেধাকে দমিয়ে রাখতে পারে না তার জীবন্ত উদাহরণ অর্পা তালুকদার। সে হাজারো শিক্ষার্থীর অনুপ্রেরণা। বিত্তবান মানুষ এবং সরকারের উচিত অর্পার পাশে দাঁড়ানো। একটু সহযোগিতা পেলে অর্পা আমাদের জন্য আরো সাফল্য এনে দিতে পারবে।
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, অর্পার সাফল্য আমাদের বিস্মিত করেছে। একটি দুর্গম এলাকা থেকে দারিদ্র্যতাকে জয় করে অর্পা যে সাফল্য এনেছে তা অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণার। আমরা শীঘ্রই অর্পার সাথে দেখা করবো। তার ভর্তিসহ সকল ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
অদম্য মেধাবী অর্পা’র স্বপ্নযাত্রা কি থেমে যাবে?
- আপলোড সময় : ৩০-০৭-২০২৫ ১২:১১:৩৫ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ৩০-০৭-২০২৫ ১২:৩৪:০৭ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ